চাকুরীতে সংরক্ষিত কোটা বরাবরই একটি বিতর্কিত বিষয়। সভা, সেমিনার, টকশোতেও শিক্ষাবিদেরা এ বিষয়ে বলে থাকেন। আবার অনেকে শক্ত হাতে কলমও ধরেছিলেন। আর ভুক্তভুগিরা সভা, সেমিনার, টকশোতে যেতে না পারলেও ফেসবুক টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখিয়েছেন কষ্টের বহিঃপ্রকাশ । কেউ আবার সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে রাস্তায় ঘুরেছে একটি চাকুরীর জন্য। কেউ আবার মহামান্য হাইকোর্টের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আবার কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করলাম চাকুরীতে সংরক্ষিত কোটা নিয়ে বেশ লিখালেখি হচ্ছে। তাই নিজের দায়িত্ব বোধ থেকে আমিও চুপ থাকতে পারলাম না। বিসিএস পরীক্ষায় যে কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%, মহিলা ১০%, জেলা কোটা ১০%, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা ৫% এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১%। এই হিসাব থেকে দেখা যায় ৫৬% কোটা সংরক্ষিত আছে। বাকি ৪৪% হচ্ছে মেধা কোটা। পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ জন প্রতিবন্ধী।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এই হিসেবে মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকছে ৫% , ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য ১% এবং শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০%। যার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নাই। এ জন্যই প্রতি বছর সংরিক্ষিত কোটা পূরণ করা নিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। ৩৫তম ও ৩৬তম বিসিএস-এ প্রার্থী না পাওয়ায় কোটার শূন্য পদে মেধা তালিকায় থাকা সাধারণ প্রার্থীদের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। এজন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপন করা দুটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। শুধু ৩৫ এবং ৩৬ তম বিসিএস-এ নয়। বেশ কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, শত শত সংরক্ষিত কোটা খালি থেকে যাচ্ছে। পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটার অল্প সংখ্যকই পূরণ হচ্ছে। গত ২১, ২২ ও ২৫ তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। আর ২৮তম বিসিএসে পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি থাকে। পরে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এসব খালি পদে নিয়োগ দিতে হয়। এজন্য সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির ‘সংস্কার’ করতে বেশ কয়েকবার সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ২০০৯ ও ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে পিএসসি বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করে বলে, “বর্তমানের কোটা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।” বুদ্ধীজীবীরাও বার বার কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করে আসছেন অনেক আগে থেকেই । সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খানও বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। আকবর আলি বলেন, “কোনো কোটাই চিরদিন থাকতে পারে না। প্রত্যেক কোটার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। দেশে যখন ১৭ জেলা ছিল তখন চালু হয় ‘জেলা কোটা’।
পরে ১৭ জেলা ভেঙে ৬৪টি করা হলেও সেই কোটাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।” মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিবের দায়িত্ব পালনকারী আকবর আলি বলেন, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করা হয়। ওই সময় তাদের অবদান ও বিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও জন্ম নেয়া তাদের সন্তানের বেলায় এটা প্রয়োগের কোনো যুক্তি নেই। তিন বার বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা দিয়েও চাকরি না পেয়ে বিভিন্ন বিসিএসের কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে বেড়াচ্ছেন তানভীর (ছদ্ধনাম)। তার এ অবস্থার জন্য তিনি কোটা পদ্ধতিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, আমরা কোটা উঠিয়ে দেয়ার দাবি করছি না। তবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাই। আমরা যারা কোনো কোটার মধ্যেই নেই, তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। আমাদের মেধার মূল্য দিন।
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
গবেষক, পিএইচ. ডি ফেলো
আইন বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভারসিটি মালয়েশিয়া এবং
শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইসলামিক ইউনিভারসিটি মালদ্বীপ