ল ডেস্ক: বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাসমূহ সুষ্ঠু, শৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থায় সম্পন্ন করতে এবং পরীক্ষা বিষয়ক অপরাধের শাস্তির বিধান করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন The Public Examination (Offences) Act 1980 পাস করে। এই আইনটি পাসের মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) অধ্যাদেশ ১৯৮০ বাতিল করা হয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে এই আইনটির কিছু অপরাধের শাস্তির বিধান সংশোধন করা হয়।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোন না কোন একটিতে প্রতিদিনই পরীক্ষা লেগেই থাকে। পরীক্ষা হলো পরীক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নের একমাত্র মাধ্যম। তাই পরীক্ষা কেন্দ্রে উচ্ছৃঙ্খল ও অবাধ্য পরীক্ষার্থীদের এবং পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িতদের অপরাধ প্রবণতা প্রতিরোধ করতে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন কার্যকরী ভূমিকা পালন করে আসছে।
পাবলিক পরীক্ষায় ভূয়া পরিচয় দানঃ
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন এর ৩ ধারা অনুযায়ী কেউ যদি পরীক্ষার্থী না হওয়া সত্তে¡ও নিজেকে পরীক্ষার্থী হিসেবে হাজির করে বা পরীক্ষার্থী বলে ভান করে কোন পাবলিক পরীক্ষার সময় পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে অথবা অন্য কোন ব্যক্তির নামে বা কোন কল্পিত নামে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তাহলে তিনি পাঁচ বছরের কারাদন্ড কিংবা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
পাবলিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার পূর্বে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্রকাশনা বা বিতরণঃ
যিনি বা যারা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে পরীক্ষার জন্য প্রণীত কোন প্রশ্ন সম্বলিত কোন কাগজ অথবা পরীক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে বলে মিথ্যা ধারণাদায়ক কোন প্রশ্ন সম্বলিত কোন কাগজ কিংবা পরীক্ষার জন্য প্রণীত প্রশ্নের সাথে হুবহু মিল আছে বলে বিবেচিত হওয়ার অভিপ্রায়ে লিখিত কোন প্রশ্ন সম্বলিত কাগজ যেকোন উপায়ে ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ করেন, তিনি বা তারা পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী দশ বছর কিন্তু তিন বছরের নিচে নয় এমন কারাদন্ডে এবং অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
ভুয়া মার্কশিট, সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা অথবা ডিগ্রি ইত্যাদি তৈরিকরণঃ
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী যিনি বা যারা কোন পাবলিক পরীক্ষার মার্কশিট, সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা অথবা ডিগ্রি যা মিথ্যা বলে জানেন অথবা তা কোন কর্তৃত্বসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড কর্তৃক জারিকৃত হয়নি বলে জ্ঞাত আছেন, কিন্তু এরপরও তা তৈরি করেন, ছাপান, বিতরণ করেন, ব্যবহার করেন অথবা আইনসম্মত অজুহাত ছাড়াই নিজের দখলে রাখেন তিনি বা তারা সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড যা তিন বছরের নিচে নয় দন্ডনীয় হবেন।
পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র পরিবর্তনঃ
৮ ধারা অনুযায়ী যিনি বা যারা কোন পাবলিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন উত্তরপত্র অথবা এর অংশবিশেষের পরিবর্তে অন্য একটি উত্তরপত্র বা এর অংশ প্রতিস্থাপন করেন অথবা পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থী কর্তৃক লিখিত হয়নি এরূপ উত্তর সম্বলিত অতিরিক্ত পৃষ্ঠা কোন উত্তরপত্রের সাথে সংযোজিত করেন তিনি বা তারা দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে যা তিন বছরের নিচে নয় এবং অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
মৌখিক বা লিখিতভাবে তথ্য সরবরাহঃ
যিনি বা যারা কোন পরীক্ষার্থীকে কোন লিখিত উত্তর অথবা কোন বই বা লিখিত কাগজ অথবা তার কোন পৃষ্ঠা কিংবা কোন উদ্ধৃতি পরীক্ষার হলে সরবরাহ করেন অথবা মৌখিকভাবে বা যান্ত্রিক উপায়ে কোন প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য বলে দিয়ে সহায়তা করেন তিনি বা তারা ধারা ৯ অনুযায়ী পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড যা দুই বছরের নিচে নয় এবং অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
অবৈধ উপায়ে পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা করাঃ
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী যিনি বা যারা বিশ্বদ্যিালয় বা বোর্ড কর্তৃক নিযুক্ত বা ক্ষমতা প্রাপ্ত না হয়েও কোন পাবলিক পরীক্ষার হলে কোন পরীক্ষা পরিচালনা করেন, অথবা কোন পাবলিক পরীক্ষা সংক্রান্ত উত্তরপত্র পরীক্ষা করেন অথবা যিনি অন্য ব্যক্তির পরিচয়ে কিংবা কল্পিত নামে পরীক্ষার হলে পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা করেন অথবা পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষা করেন তিনি বা তারা পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড তবে দুই বছরের নিচে নয় এবং অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
দায়িত্ব পালনে বাধাদান বা গোলযোগ সৃষ্টিঃ
যিনি বা যারা কোন পাবলিক পরীক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে কাউকে বাধা প্রদান করেন অথবা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করেন অথবা কোন পরীক্ষার হলে গোলযোগ সৃষ্টি করেন তিনি বা তারা এক বছরের কারাদন্ড কিংবা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও অপরাধ করাঃ
যিনি বা যারা বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডের কোন অফিসার কিংবা কর্মচারী হয়েও অথবা পাবলিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন কর্তব্য ও দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও এই আইনের অধীনে কোন অপরাধ করেন তিনি বা তারা ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদন্ড কিংবা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন প্রসঙ্গে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র কে.এম.মবরুক এর মতে, পরীক্ষা কেন্দ্রে নকল অথবা অপরাধ কেন করবো? ভালভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করলে এবং শিক্ষকদের পরামর্শ মেনে চললে পরীক্ষা কেন্দ্রে কোন অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির এলএল.এম এর ছাত্র ইয়াসির আদনানের মতে, আজকাল শিক্ষার্থীরাই যে কেবল অপরাধ করছে তা নয় বরং একশ্রেণীর শিক্ষক, অভিভাবক ও পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও পরীক্ষা কেন্দ্রে অপরাধ করতে পরীক্ষার্থীকে মানসিকভাবে উৎসাহিত করছেন।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শরীফ মোহাম্মদ আবুল হোসেনের মতে, পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে আসার আগে প্রবেশপত্রের পেছনে লিখিত নিয়মাবলি মনোযোগ সহকারে পড়লে তাদের অপরাধ প্রবণতা ৯০ শতাংশই হ্রাস পাবে। তিনি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে কৃত অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃদু ভৎর্সনা, কান ধরে ওঠবসের ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে আইন প্রয়োগের পরামর্শ দেন।
শিক্ষাবোর্ডসমূহের কম্পিউটার কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে সাতটি সাধারণসহ নয়টি শিক্ষাবোর্ডের এসএসসি ও এইচএসসি মোট বহিষ্কার করা হয়েছিল ৪০ হাজার ৪১১ জন পরীক্ষার্থী। ২০০২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৯৭০ জন, ২০০৩ সালে ১৩ হাজার ২১৭, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৩৮১ এবং ২০০৫ সালে ১ হাজার ৭৪৮ জন। এই পরিসংখ্যানই দেশে পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধের ভয়াবহতা তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। আজকের শিক্ষার্থীই ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাই তাদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে আমাদেরকে অপরাধের ফলাফল সম্পর্কে সম্যক ধারনা প্রদানের পাশাপাশি সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে, যেন পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে অপরাধ প্রবণতার দিকে না ঝুঁকে। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি এক্ষেত্রে পারিবারিকভাবেও সচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এখন একান্তভাবে অপরিহার্য।