নিউজ ডেস্ক: সিনডেরেলা নামের সেই মেয়েটির কথা, যার সৎ মা তাকে সারাদিন নানা রকম কাজে ব্যস্ত রাখতো আর ভীষণ অত্যাচার করতো। খেলাধুলা করার অথবা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি দিত না। একদিন ইচ্ছে পরী এসে যার জীবনটাই পাল্টে দিল। অথবা মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, গুফি এলিস, পিনোকিও- এরা সবাই যেন আমাদের অতি পরিচিত বন্ধু। ছেলেবেলায় এদের নাম বা ছবি দেখলে আমাদের মন যেমন খুশিতে চনমন করে উঠত; ঠিক তেমনি এখনকার ছেলেমেয়েরাও দেখি আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। আর বিচিত্র এই চরিত্রগুলোর যিনি স্রষ্টা তার নাম হচ্ছে ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি বা ওয়াল্ট ডিজনি।
ওয়াল্ট ডিজনি ছোটদের জন্য অবাক এক পৃথিবী বানিয়ে গেছেন; যেখানে পরিবারের সকলের জন্য রয়েছে হাসি, গান, আনন্দ আর নানা রকম মজাদার সব কর্মকাণ্ড। ১৯৫৫ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে ‘ডিজনিল্যান্ড’ নামে ছোটদের জন্য স্থায়ী এই আনন্দরাজ্য তৈরি করেন তিনি। এখানকার বেশিরভাগ দেখার জিনিস তৈরি হয় ডিজনির বিভিন্ন কার্টুন ছবির চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে। এর দারুণ সাফল্য দেখে ১৯৭১ সালে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো শহরে বিশাল এলাকা জুড়ে প্রায় ৪৩ বর্গমাইল চৌহদ্দি নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড’ বা ডিজনির জগৎ নামে আরেক স্থায়ী শিশু-কিশোর আনন্দমেলা। নামে শিশু-কিশোর হলেও এখানে বড়রাও কিন্তু আসে দলে দলে। দুনিয়ার নানা দেশ থেকে হাজার হাজার লোক আসে ডিজনির এই জগৎ দেখতে। আমেরিকা এসে ডিজনির জগৎ না দেখলে মনে হয় যেন এদেশের অর্ধেকটাই দেখা বাকি রয়ে গেল। ডিজনিল্যান্ড নামে সুপরিচিত সেই স্বপ্নরাজ্য দেখার আগ্রহ আমার সেই শৈশব থেকেই। তাইতো মায়ামীতে যখন ছোটবোনের বাসায় বেড়াতে গেলাম- তালিকার প্রথমেই থাকলো ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড’ সফর।
ডিজনি ওয়ার্ল্ডের বড় আকর্ষণ হচ্ছে ‘ম্যাজিক কিংডম’ বা জাদুর রাজ্য। প্রধান ফটকের সাথে টিকেটঘরের গায়ে বড় বড় করে লেখা আছে টিকেটের দাম। একদিনের জন্য টিকেটের দাম ২০ ডলার, তিনদিনের বা সাতদিনের জন্য একসঙ্গে কিনলে তুলনামূলকভাবে কম খরচ পরে। একদিনে এই স্বপ্নময় জগতকে ঠিকভাবে উপভোগ করা যায় না।
সাধারণ ট্রেন চলে দু’পাটি রেলের ওপর আর মনোরেল চলে বিজলিতে- মাটি থেকে বেশ খানিক উঁচুতে মাত্র একটি রেলের ওপর দিয়ে। মনোরেল থেকে নামতেই চোখে পড়বে ঝলমলে ‘ম্যাজিক কিংডম’র বিশাল তোরণ। ভেতরে পা বাড়াতেই দেখা যাবে যাত্রী বোঝাই লাল ডিজনি রেলগাড়ি হুস হুস করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মাথার ওপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর রেলের কামরার জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ছেলে, বুড়ো সকলে। বুড়োরা চুপ থাকলেও শিশু-কিশোররা আনন্দ-হুল্লোড় আর উৎসাহে ফেটে পড়ে হাত নেড়ে অন্যদের দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করে।
প্রধান সড়কে ঢুকতেই চোখে পড়বে চিরচেনা মিকি মাউস তার অতি পরিচিত অঙ্গভঙ্গি দিয়ে পথচারীদের বিশেষ করে ছোটদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সিনডেরেলার প্রাসাদটি যেন বইয়ের পাতায় আঁকা। বিকেলে ডিজনির সবগুলো কার্টুন চরিত্রগুলোর প্যারেড শো বের হয় যা ম্যাজিক কিংডমের অন্যতম আকর্ষণ। আর রাতে লেজার শো আর আতশবাজি পোড়ানো হয়।
স্বপ্নীল এই জগতের স্রষ্টা ডিজনি কিন্তু জন্মেছিলেন দরিদ্র এক পরিবারে। প্রতিদিনের খাবার জোগার করাটাই তাদের পরিবারের জন্য কষ্টকর ছিল। আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৯০০ সালে তার জন্ম। শৈশবে ছবি আঁকা শিখে এক বিজ্ঞাপন অফিসে তিনি কাজ নেন। তাদের কাজ ছিলো সিনেমা হলে দেখানোর জন্য কার্টুন ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করা। তখন ছিল নির্বাক ছবির যুগ। বিজ্ঞাপনের ছবি করতে করতে ডিজনিরও ইচ্ছে হল নিজে একটা ছায়াছবি তৈরি করবেন। আর তাই তো ছায়াছবির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে ছবি তৈরিতে লেগে পড়েন। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে কার্টুন তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। একটা মোটর গাড়ির গ্যারেজ হল তার ছবি তৈরির স্টুডিও। তিনি খেয়াল করলেন ইঁদুরের চরিত্র নিয়ে কার্টুন ছবি তৈরি করা বেশ সুবিধার। কতগুলো গোলমতো অংশ জুড়ে দিলেই ইঁদুরের চেহারা হয়ে যায়। ১৯২৮ সালে তার প্রথম কার্টুন ছবি ‘মিকি মাউস’ মুক্তি পায়। ডিজনি আধুনিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানাবেন বলে ঠিক করেন। ১৯৩৯ সালে তৈরি করলেন ‘তুষারকন্যা ও সাত বামন’। ছবিটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেল। এরপর ক্রমে ক্রমে তৈরি হতে থাকল- পিনোকিও (১৯৪০), ব্যাম্বি (১৯৪১), সিনডেরেলা (১৯৫০), অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড (১৯৫১), পিটার প্যান (১৯৫৩) এমনি বিখ্যাত সব ছবি।
ইতিমধ্যে বিজ্ঞান এগিয়ে গেল আরো এক ধাপ। টেলিভিশন নামক যন্ত্রটি তখন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। লোকে ভাবলো টেলিভিশন এলো এবার ছায়াছবির ভরাডুবি নিশ্চিত। কিন্তু দেখা গেল টেলিভিশনওয়ালারাও ডিজনির কার্টুন প্রচার করতে লাগল। আর এভাবেই ওয়াল্ট ডিজনি সারাদেশের, বিশেষ করে ছোটদের মনে ঠাঁই করে নিলেন চিরতরে। তাঁর তৈরি করা ছবি একটার পর একটা পুরস্কার পেতে থাকল।
ছুটির দিনগুলোতে মেয়েদের নিয়ে তিনি প্রায়ই বেড়াতে বের হতেন। কাছাকাছি কোন পার্কে বসে মেয়েদের নিয়ে নাগরদোলায় চড়তে চড়তে একসময় একঘেঁয়েমি পেয়ে বসে তাকে। তখন থেকেই তার ভাবনায় ঠাঁই পায় কীভাবে এই একঘেঁয়েমি আনন্দের পরিবর্তে মা-বাবা, দাদা-দাদু, ছোট-বড় সবার জন্য আনন্দের ব্যবস্থা করা যায়। যেখানে থাকবে পরিবারের সকলের জন্য হাসি, গান, আনন্দ আর নানারকম মজা। আর এভাবেই জন্ম নিল ডিজনিল্যান্ডের। যা এখনো সব বয়সের মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।